Thiksey Monastery

শান্তির সংঘারামে

Baishakhi Kar

বৈশাখী কর

সলতে পাকানোর পর্বটা শুরু হয়েছিল অন্তত বছর ২০ আগে। শঙ্কু মহারাজের “লাদাখের পথে” পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় মানস ভ্ৰমণ। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সময়ের ফারাক থেকেই যায়। আমাদেরও তাই হল। ২০০০ সালে দেখা স্বপ্নের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটল ২০১৯-এ এসে৷ বছর খানেক আগে থেকে বিস্তর খোঁজখবর আর গবেষণার পর ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে যাওয়া ঠিক হল। শঙ্কু মহারাজের বইতে পড়েছিলাম হেমিস ও থিকসে গুম্ফার কথা। বিশেষ করে হেমিসের প্রাচীনত্ব, স্বামী অভেদানন্দ ও নিকোলাস নটোভিচ এর কথা জানতে পারি সেই বই থেকে। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল যাওয়ার৷ কাজেই প্রথম সুযোগে পুরো একটা দিন বরাদ্দ রেখেছিলাম গুম্ফাগুলোর জন্য। আরও পড়ুন-ওল্ড সেমেট্রি ও দার্জিলিংয়ের ইতিকথা

সময়টা ১৫ শতকের শুরুর দিকে, তিব্বতে প্রতিষ্ঠা হল হলুদ টুপি পরা গেলুগপা বৌদ্ধসম্প্রদায়ের। তাদেরই একজন ১৪৩৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই থিকসে গুম্ফা। দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী এই বৌদ্ধ মঠের স্থান মাহাত্ম্য হেমিসের পরেই। গাড়ি থামল ঠিক মঠের গেটের সামনে। বিশাল তোরণ, মাথায় ধর্মচক্রের প্রতীক। গেটের মুখেই প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঢোকা হল, জনপ্রতি ১৩০ টাকা। চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর অদ্ভুত নীরবতা। ঢুকেই বা দিকে লম্বা ক্যান্টিন, ডানদিকে উফরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম বিশাল ধর্মচক্রের সামনে। পিছনেই রয়েছে গেলুগপা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা য়ে স্তোনখাপার ম্যুরাল। সেখান থেকে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে উঠে এলাম মূল গুম্ফার চত্বরে।



১৯৯০ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের উদ্যোগে এই বিশাল চত্বর বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। একটা অদ্ভুত শান্তি আর নীরবতা বিরাজ করছে পুরো মঠজুড়ে। মন শান্ত হয়ে এল। ডানদিকের সিঁড়ি বেয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করে আপনা থেকেই হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম। সামনে পদ্মসম্ভবের বিপুলাকার মূর্তি। তার চেয়েও মায়াবী তাঁর শান্তিঘন দুটি চোখ। সেই দৃষ্টি যেন আদিগন্ত রূক্ষ মরু প্রান্তরের উপরে অপার করুণা বর্ষণ করে চলেছে। মনের মধ্যে তখন গুঞ্জরিত হল সেই শান্তি মন্ত্র, “অসতো মা সদগময়, তমসোমা জ্যোর্তিগময়”। অপার প্রশান্তি ও আনন্দের রূপে সেখানে সময় যেন থমকে আছে। আরও পড়ুন-পৃথিবী কবে সুস্থ হবে? এই বৈশাখে স্বপ্ন দেখি…

Thiksey Monastery
থিকসে গুম্ফা (Photo Credits: Baishakhi Kar)

একটু সম্বিত ফিরলে আশপাশে দেখতে শুরু করলাম। পাশেই তারাদেবীর মন্দির। আমাদের তারাপীঠের মা বৌদ্ধ বজ্রযান তন্ত্রেও প্রবল ভাবে আছেন। কাচের বাক্সে তাঁর বিভিন্ন রূপের মূর্তি। চত্বরের অন্যদিকে মূল উপাসনা গৃহ ও দলাই লামার মন্দির। ছোট সিঁড়ি উঠে গেছে প্রধান লামার ঘর ছাড়িয়ে ছাদের দিকে। পাথরের ছাদ থেকে লাগোয়া এলাকার চারদিক খোলা অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, আদর্শ Panoromi C view৷



দিনের বেলা, তাই সূর্যের তাপ যথেষ্ট। গেটের মুখেই পানীয়জলের জালা, পান করে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এখানে এলে মন একটু থিতু হয়ে বসতে চায়। কিন্তু সময় যে বড় বালাই, এবার এগিয়ে যেতে হবে লাদাখের অন্যতম প্রধান ও মূল মঠ হেমিসের দিকে। ভগবান তথাগতর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে অপার শান্তির থিকসে থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা৷

এবার গাড়ি ছুটে চলল হেমিসের দিকে। সেই হেমিস, যার সম্পর্কে কত জনশ্রুতি আছে। সত্যিই কি আমরা এগোচ্ছি যীশু খ্রিষ্টের পায়ের ছাপ ধরে? নিকোলাস নটোভিচ বা স্বামী অভেদানন্দ| যিনি হেমিসে দিনের পর দিন কাটিয়ে গেছেন৷ সেই হেমিসের মাটিতে আজ পা দেব আমরা। ১১০০ শতকে গুরু নারোপা হেমিসে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন৷ পরবর্তিতে ১৭৪২ সালে রাজা সেন্যে নামগিয়াল এই মঠের পুণর্নির্মাণ করান। এটি মূলত দুকপা সম্প্রদায়ের মঠ। আগের দুর্গমতা এখন পিচরাস্তার সৌজন্যে সুগম হয়েছে।



লেহ মানালি হাইওয়ে ধরে লেহ শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদের অপর পারে হেমিস গুম্ফা অবস্থিত। নদীর এপারে কারু হাইওয়ে বরাবর জনপদ। সেখানেই রুটি, গরমাগরম আলুরদম আর  অমলেট দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে গাড়িতে উঠলাম। আরও পড়ুন-“রোগ তো শরীরের হয়েছে, আমি আনন্দে আছি”

 

Hemis Monastery
হেমিস গুম্ফা (Photo Credits: Baishakhi Kar)

নদী পার হয়ে পিচ রাস্তা উঠেছে পাহাড়ের ঢালে। দুই পাহাড়ের মাঝের খাঁজে হেমিস গুম্ফা যেন পাহাড়ের গা আঁকড়ে ধরে ঝুলে আছে। সিঁড়ি উঠে গেছে সদর দরজা পর্যন্ত। দরজার মুখে ১৫০ টাকা জনপ্রতি প্রবেশমূল্য দিয়ে পা রাখলাম সেই পূণ্যভূমিতে। মঠ ঘিরে রয়েছে সুবিশাল চত্বর৷ এই চত্বরেই প্রতিবছর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত “হেমিস ফেস্টিভ্যাল”। বসে ছাম নৃত্যের আসর। চত্বরের ডানদিকে মূল উপাসনা গৃহ। দেওয়ালে আঁকা গুরু পদ্মসম্ভবের ম্যুরাল গুলো মোমের মৃদু আলোয় যেন ঝলমল করছে। এখানে পা দিলে সময়ের প্রাচীনত্ব অনুভব করা যায়।



হেমিসের অন্যতম আকর্ষণ তার মিউজিয়াম। চত্বরের শেষ মাথায় সদর দরজার সোজাসুজি স্যুভেনিরের  দোকান৷ এই দোকানের ভিতর দিয়েই মিউজিয়ামে যাওয়ার রাস্তা। মিউজিয়ামে প্রবেশের আগে লকারে ক্যামেরা, ব্যাগ ও মোবাইল ফোন জমা রাখতে হল। ভিতরে পা দিতেই যেন অনেকটা পিছনে ফিরে গেলাম৷ হেমিসের ইতিহাস এখানে সুচারুভাবে সংরক্ষিত রয়েছে৷ হেমিসে গেলে এই মিউজিয়াম কিন্তু অবশ্য দ্রষ্টব্য। সেখানে সময়ানুসারে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন ব্যবহৃত সামগ্রী, পোষাক, অস্ত্রশস্ত্র৷

Hemis Monastery
হেমিস গুম্ফা (Photo Credits: Baishakhi Kar)

দিনের শেষ আলো ঢলে পড়ছে পাহাড়ের কোলে৷ নদীর একটানা কুলুকুলু ধ্বনি সঙ্গে নিয়ে পপলার গাছের সারির ফাঁকে ফিরছি আমরা। প্রাচীন রহস্যময়তার সাক্ষী হয়ে পিছনে পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যার ছায়া মেখে দাঁড়িয়ে আছে হেমিস৷ পাহাড়ি মরুর দেশে যেন সময় থমকে গেছে| উচ্চারণ করছে সেই মহাকারুণিকের শান্তির ললিত বাণী।।

 

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।